Wednesday, October 31, 2012

রোবটিক্সের তিন সূত্র - আইজ্যাক আসিমভ


(The original text is Isaac Asimov's "The Laws of Robotics" written in 1979.)

কম্পিউটার জিনিসটা সম্বন্ধে চিন্তা করার সময় এই চিন্তা মাথার বাইরে রাখা মনে হয় সহজ না যে তারা কখনও পৃথিবী “দখল” করে নিবে নাকি।
তারা কি আমাদের জায়গা নিয়ে নিবে, অপ্রয়োজনীয়-অপাংক্তেয় বানিয়ে ফেলবে আর তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিবে আমাদের যেভাবে আমরা পুরানো ভাঙ্গা যন্ত্রপাতি ফেলে দিই? ঠিক যেমন আমরা একসময় ঢাল-বর্শা ফেলে দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছি আধুনিক সমরাস্ত্র। পাথরে পাথর ঠুকার বদলে আগুন জ্বালানো শুরু করেছি ম্যাচের কাঠি পরে লাইটার দিয়ে।
কম্পিউটারের মত ব্রেন যদি আমরা চিন্তা করি মানুষের মত দেখতে ধাতব একটা যন্ত্রের ভিতর যাকে কিনা আমরা বলি রোবট তাহলে ভয়টা মনে হয় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কল্পনার রোবট দেখতে এত বেশি মানুষের মত যে তাদের চেহারাই যেন তাদেরকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার বুদ্ধি যোগাবে।
বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর জগত এই সমস্যারই মুখোমুখি হয়ে ছিল ১৯২০ আর ১৯৩০ এর দশকে। আর সেই সময়ের গল্পগুলোর অনেকগুলোই ছিল রোবটদের ব্যাপারে সাবধানবানী। কিভাবে তারা একসময় গিয়ে তাদের নির্মাতা মানুষের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের ধ্বংস করে দেয়।
আমি যখন কেবলই তরুণ তখন আমি এই সাবধানবানী শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। আমার মনে হত রোবট তো শেষ পর্যন্ত একটা যন্ত্রই, আর মানুষ সবসময়ই নতুন নতুন যন্ত্র বানাচ্ছে। আর সব যন্ত্রই তো কোন না কোনভাবে বিপদজনক, তাই মানুষ কি করে? যন্ত্রের মধ্যে এমন কোন ব্যবস্থা করে দেয় যেন তা নিরাপদভাবে ব্যবহার করা যায়।
সেই সময়, ১৯৩৯ সালে আমি তাই এমন গল্প লিখা শুরু করলাম যেখানে রোবটকে উপস্থাপন করা হয়েছে ভয়ের সাথে না, সহানুভূতির সাথে। এমন যন্ত্র হিসেবে যা এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে যেন তাকে ব্যবহার করা যায় নিশ্চিন্তে, যার মধ্যে হিংস্র মনোভাব থাকার সম্ভাবনা নেই আর সর্বোপরি যা তাকে যে কাজ দেওয়া হয় সেটা ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পারে।
তো নিরাপদ রাখার জন্য কি কি “safeguard” বা রক্ষাকবচ রাখতে হবে ডিজাইনের সময়? এই জিনিসটাই আমি প্রথম অক্টোবর, ১৯৪১ এর একটা গল্পে লিখি সুনির্দিষ্ট করে “রোবটিক্সের তিন সূত্র” হিসেবে। সূত্রগুলো হচ্ছেঃ
  • একটা রোবট কখনোই একজন মানুষকে আঘাত করতে পারবে না কিংবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোন মানুষের উপর আঘাত আসতে দিতে পারবে না।
  • একটা রোবটকে অবশ্যই কোন মানুষের সকল আদেশকে মান্য করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই আদেশ প্রথম সূত্রকে অমান্য করে। 
  • একটা রোবট অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করে চলবে যতক্ষন পর্যন্ত না রক্ষা করতে গিয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় সূত্রকে ভঙ্গ করতে হয়।
এই সূত্রগুলো অবশ্যই একটা রোবটের কৃত্রিম মস্তিষ্কে/Processing unit-এ প্রোগ্রাম করে দিতে হবে। তো আমি এই সূত্রগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেকগুলো গল্প লিখলাম, বলা যায় লিখতে থাকলাম। এই সূত্রগুলো এত জনপ্রিয় হল পাঠকদের মধ্যে যে আমার সময়ের অন্য অনেক বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকও এই সূত্রগুলো মাথায় রেখে গল্প লিখতে লাগলেন আর আগের যুগের রোবটের আমাদের ধ্বংস করে দেওয়ার কাহিনী ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।
কিন্তু এটা তো সায়েন্স ফিকশনের কথা। আসল দুনিয়ায় কি হচ্ছে? এখন কম্পিউটার আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে, সেখানে কি হচ্ছে? সেখানেও কি এরকম রক্ষাকবচ রাখা হবে তাদের ডিজাইনেই? যেসব যন্ত্রের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা থাকবে তাদের মাথাতেও কি রোবটিক্সের তিনটি সূত্রের মত কিছু থাকবে তাদের নিরাপদ বানানোর জন্য?
অবশ্যই থাকা উচিৎ, যদি ধরে নিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা মানুষজনের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা খুব নিম্নশ্রেণীর না। এবং তাদের যে রক্ষাকবচ থাকবে তা যে শুধু রোবটিক্সের তিনটি সূত্রের মত হতে হবে তাই না, সেগুলোকে রোবটিক্সের তিনটি সূত্রই হতে হবে। আমি যখন সূত্র তিনটি লিখি তখন বুঝি নি যে আমি যা লিখেছি তা আসলে মানুষ অনেক অনেকদিন ধরে প্রয়োগ করে আসছে, যদিও ঠিক রোবটিক্সের সূত্র হিসেবে না। বরং বলা যেতে পারে আমি লিখে ফেলেছিলাম সার্বিক ভাবে “যেকোন যন্ত্রের তিন সূত্র”। কিরকম? সেগুলো হতে পারে এরকমঃ
  • যেকোন যন্ত্রকে হতে হবে নিরাপদ। (স্বাভাবিক! যেমন একটা ছোরার আছে হাতল, একটা ভোঁতা দিক। এমন যন্ত্র যা তার ব্যবহারকারী সাবধানে থাকার পরেও তার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে নিশ্চয়ই একটা ভালো যন্ত্র হিসেবে গন্য হবে না। এটা কখনো নিয়মিত ব্যবাহার্যও হয়ে উঠতে পারবে না।)
  • একটা যন্ত্রের যা করার কথা, সেটা অবশ্যই তা করবে। এবং অবশ্যই নিরাপদভাবেই করবে, অন্য কারও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।
  • একটা যন্ত্র অক্ষত থাকতে হবে কাজের সময় যদি না তাকে ধ্বংস করা নিরাপত্তার জন্য দরকারী হয় অথবা তার ধ্বংস হওয়া তার কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে।
এই তিনটা সূত্র কেউ কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারণ করে না তার কারণ এরা অতিরিক্ত রকমের স্বাভাবিক। এগুলো যদি কারও সামনে বলা হবে তার প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা “এটা আবার বলে দিতে হয় নাকি!”।
স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে “রোবোটিক্সের তিন সূত্র” আর যেকোন যন্ত্রের তিন সূত্র হচ্ছে একই জিনিস। আর হবে নাই বা কেন, রোবট/কম্পিউটার এগুলোতো মানুষের তৈরি আরেকটা যন্ত্র ছাড়া কিছু না।
এখন রোবটের মধ্যে যে সেফগার্ড প্রোগ্রাম করে দেওয়া থাকবে তা কি যথেষ্ট হবে? রোবট তাতে “নিরাপদ” হয়ে উঠবে? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন উদাহরণ থেকে দেওয়া যাক। সাধারণ একটা গাড়িকে নিরাপদ করে তুলতে তো কম কষ্ট করা হয় না, নিত্যনতুন গ্যাজেট আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢোকানো হয়। কিন্তু তারপরেও আমেরিকাতে বছরে পঞ্চাশ হাজার মানুষ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। চিন্তা করুন, ব্যাঙ্কে আমাদের টাকা নিরাপদে রাখার জন্য ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি বাড়ানো হয় কত-শত ভাবে আর তারপরেও একের পর এক ব্যাঙ্ক ডাকাতি হতেই থাকে। কম্পিউটার প্রোগ্রামের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার জন্যও কত কিছু করা হয় আর তারপরেও হ্যাকিং, ক্র্যাকিং, কম্পিউটারে জালিয়াতি এসবের কত নজিরই তো সামনে।
যাই হোক, রোবটের ক্ষেত্রেও এরকম কিছু হতে পারে কিন্তু তারা আমাদের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করবে এটা অনেকটাই অস্বাভাবিক। বরং তারা যদি কখনও সবকিছু দখল করে নেওয়ার মত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হয়েই উঠে তারা হয়তো এতটা বুদ্ধিমানও হয়ে উঠবে যে তাদের আর তিনটি সূত্র দিয়ে চালিত হতে হবে না। তারা তাদের নিজেদের সদিচ্ছা থেকেই আমাদের খেয়াল রাখবে আর আমাদেরকে আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করবে।
এখানে এসে কেউ কেউ আপত্তি জানাতে পারেন। আমরা তো আর সবাই বাচ্চা-কাচ্চা না, আমাদের মানবসত্তার উপর, আত্মাভিমানের উপর এটা একটা আঘাত হবে যদি আমাদের এভাবে রক্ষা করে রাখতে হয়।
আসলেই কি তাই? আজকের বিশ্বের দিকে তাকান, অতীতের দিকে তাকান আর তারপর নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আমরা কি বাচ্চাদের মতই আচরণ করি না? শুধু তাই না বরং ধ্বংসাত্বক বাচ্চা-কাচ্চা। আর ভাবুন নিজেদের কাছ থেকেই নিজেদের রক্ষা করাটা জরুরি মনে হয় কিনা।
আমরা যদি দাবি করি যে আমাদের সাথে প্রাপ্তবয়স্কের মত আচরণ করা হোক, তাহলে কি আমাদেরই উচিৎ না প্রাপ্তবয়স্কের মত আচরণ করা? তাই যদি হয় তবে কবে আমরা তা করা শুরু করব?