Monday, January 21, 2019

রাখাল-বালকের খেরোখাতা



“বেশিরভাগ ‘মজার’ কাজ করার জন্যই মেলা লোক পাওয়া যাবে। কোন কাজটা করা দরকার কিন্তু লোক নাই সেইটা দেখ”
এই কথাটা কে বলেছিল এদ্দিন পর আর মনে নাই, তবে বলেছিল যে বাঁধন নিয়ে এইটা মনে আছে। সময়কাল ২০১০, ১-১। মনে ছিল শেষ পর্যন্ত। ইইই ডে-তে করতে গেছি, লোকজনের অভাব ছিল না, আমি না থাকলেও চলবে বুঝেই কাজ করেছি। ব্যাচ প্রোগ্রামে ‘ব্যাচ স্পিরিটে’ উদ্বুদ্ধ মানুষের অভাব ছিল না, অল্পই করতে হয়েছে নিজেকে। বাঁধনের ক্ষেত্রেও বলা যায় ব্লাড দেওয়ার লোকের বুয়েটে অভাব ছিল না, সম্ভবত অভাব হবেও না। কিন্তু কর্মী? একটা কল আসলে রুমে রুমে গিয়ে ব্লাড খোঁজার মত লোক, মানুষজন মোটিভেট করার মত লোক, হল-প্রতি, ব্যাচ-প্রতি, টিকে যাওয়া কর্মী ৪-৫ এই সীমাবদ্ধ থাকত। টিকে থাকা বাকি মানুষগুলোকে দেখতুম, আর নিজেকেই বলতুম, “এইটা ছাড়িস না রে বাই।“

“তুই সুপারম্যান না। দুনিয়ার সব লড়াই তোর না”
এইটা বুঝেছিলাম মনে হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ করার সময়। অল্প কয়টা মানুষ ছিলাম আমরা। কিন্তু দৌঁড়-ঝাঁপ করেছিলাম ভালোই। শহীদ মিনারে বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকি। সেইটাই আমাদের ‘অবস্থান’ আন্দোলন। ঢাকা বোর্ডের অফিসে গিয়ে চেঁচামেচি করে আসি। মাঝে মাঝে কি খেয়াল মাথায় আসে, কেউ কেউ গিয়ে রাস্তাঘাটে র‍্যান্ডম পথচারীর কাছে গিয়ে প্রশ্নফাঁসের কুফল বর্ণনা করে। র‍্যান্ডম পথচারী থেকেই প্রশ্ন শুনে এসে আমাদের কাছে রিপিট করে। “দেশে কি আর সমস্যা নাই? এইটা নিয়ে পড়সেন কেন?” নিজেরও মনে হয় হয়তো আচমকা, তাই তো, লোকে খাইতে পারে না, পরতে পারে না, ভোট দিতে পারে না, আর আমরা আছি এই এক প্রশ্নফাঁস নিয়ে। এই ফ্যালাসিটা বিপদজনক। এক দিকে কিছু করতে পারি না, তার জন্য অন্যদিকের কাজ তো আর প্রভাবিত হতে দেওয়া যায় না। অন্য ইস্যু নিয়ে হয়তো অন্য কেউ কাজ করছে, না করলে করবে। আমরা যেটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি তাইই আমরা কন্টিনিউ করি। একসাথে হাজারটা দিকে তাকানোর থেকে এইটা অনেক বেশি কার্যকর।

“বনের মোষ তাড়াইতে তোর ভাল্লাগে, এইটা স্বীকার করে কাজে নাম”
জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ কমবয়সে দাগ ফেলা একটা ছোটগল্প। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের দিকে যখন ‘আর্মচেয়ার এক্টিভিস্ট’ এ পরিণত হচ্ছি ধীরে ধীরে, খুব গ্লোরিফাই করতাম ব্যাপারটাকে। আহা, কি যে দুনিয়া উদ্ধার করে দিচ্ছি, সমাজের পাওনা মেটাচ্ছি। নিজেকে অন্যদের তুলনায় একটা মোরাল হাই গ্রাউন্ডেও রাখতাম বৈকি। পরের দিকে মনে হইত এগুলো সব ভুংচুং। আমি কাজ করছি তার একটা মাত্র কারণ: ভাল্লাগে। ব্লাড দিয়ে আসলে, রোগীর বাবার হাসিটা দেখলে ভাল্লাগতো। অনেক কষ্ট করে একটা প্রোগ্রাম নামিয়ে পার্টিসিপেন্টদের কাছ থেকে ‘Good job!’ শুনতে ভাল্লাগতো। বন্ধুর পথে নেমে পথের সাথী পেয়ে গেলে সেই সাথীদের খুব আপন লাগতো। হয়তো সমাজকে কিছু ফেরত দেওয়ার সেরা উপায়ও এইটা না। আমার যা করার কথা তাইই করলে, ভালোমত পড়াশোনা করে কাজের কাজ কিছু করলে সমাজের বেশি উপকারে আসত কি? অস্বাভাবিক না। তাই স্বীকার করে নিলাম যে এই তথাকথিত কাজের কাজ না করে অন্য কিছু করার ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগে। বেশ ভালো লাগে। গান শোনা, অ্যানিমে দেখা, বই পড়া, আর ‘ফেসবুকিং’ করার মতই আর কি। ‘সমাজের পাওনা মেটানো’ দশা থেকে এই তুলনামূলক বেশি ম্যাচিওর দশাতেই মনে হয় ভাল ছিলাম বেশি। আরেকটা জিনিসও এই বোঝাটায় কাজে দিয়েছিল বেশি। ঐ অল্প একটু দুনিয়া বাঁচানোর নিয়ত নিয়ে ঢং-এর ‘ভলান্টারি’ এক্টিভিটি মনে হয় সবাইই করে। কম মানুষই এই ঢং-এর কাজটা কে দিনের পর দিন, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরেও করে যেতে পারে। এই অসাধারণ মানুষগুলোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই সবার আগে চোখে পড়ে তাদের আনন্দটা। কাজ করার সময় চোখ যেভাবে চকচক করে সেইটা। এরকম একটা মানুষই ঐ বনের মোষ বিষয়ক উক্তিটা দিয়েছিল।

“কি লাভ হবে ভাবার সময় এইটা না, সময় হল কি ঠিক আর কি ভুল সেইটা ভাবার”
বুয়েটে ছেড়েছি এখনও দু’বছর হয় নাই। এখনই আর আগের মত চিন্তা করতে পারি না। সবকিছুর আগে ভাবি ‘আচ্ছা এইটা করে কি লাভ?’। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই যখন ‘Business case’ চিন্তা করি, তখন গা ঘিনঘিন করে ওঠে একটু। এইরকম তো হইতে চাই নাই। অল্পবয়সী রাখালবালক(/বালিকা)-দের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা মনে হয় এইটা। এই সময়টাতে ‘আচ্ছা এইটা করে কি লাভ হবে?’ চিন্তা করার কিছু নাই। প্রশ্ন-ফাঁস কি কেউ বন্ধ করতে পারত? যেখানে প্রশাসন সচেষ্ট না? নাহ। এক মুহূর্তের জন্যেও কেউ ভাবি নাই আমরা পারতাম। তার পরেও একটা cause নিয়ে যদি মাঠে নামতে চাও, চিন্তা কইরো না কদ্দুর কি অর্জন করতে পারবা। নেমে পড়। কি হবে-না হবে সেটা পরের ব্যাপার। জরুরি হল তোমার ঠিক-ভুলের সেন্স। আর কিচ্ছু না। সুশীল ট্যাগ খাবা? খাও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হবে? হোক। দিনশেষে অর্জন হবে শূন্য? নাহ। উচিৎ/অনুচিতের যে ছাঁকুনিটা পাবা, সেটা সারা জীবন কাজে দিবে। ঐটাই দিনশেষে রাখাল-বালকের পাওয়া।

[শেরে বাংলা হলের ’০৯ ব্যাচের নাম ছিল অনুনাদ। নামটা আহসানুল্লা হলের রেসিডেন্ট এই অধমের প্রস্তাব করা ছিল। সিস্টেমের মার-প্যাঁচে ১-১, ১-২ শেরে বাংলাতেই কাটিয়েছিলাম, অনৈতিকভাবে কারও জায়গা দখল না করেই অবশ্য। বুয়েট জীবনে ‘দুব্বল রাখাল বালক’ হয়ে ওঠাটা শেরে বাংলা হল বাঁধন আর এই অনুনাদ ’০৯ এর সংস্পর্শে না আসলে কখনোই হয়ে উঠত না। এই লেখা এদের প্রতি ‘উৎসর্গ’ করলুম]


- ফরহাদ মহসিন, ৬ মে '১৭

No comments:

Post a Comment