Monday, July 29, 2019

আপাত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার-স্যাপার (Supposedly Irrelevant Factors)

(কয়েকদিন হল অর্থনীতিবিদ রিচার্ড থেলারের আংশিক জীবনী, আংশিক টেক্সটবুক ঘরানার বই Misbhevaing: The making of behavorial economics পড়া শুরু করেছি। অনেক জায়গায় বইটাকে Professional Memoir হিসেবে বর্ণনা করতে দেখেছি, যেটা অনেকাংশে ঠিক। প্রফেসর থেলার পিএইচডি থিসিসের সময় (১৯৭০) থেকে শুরু করে মোটামুটি ২০১০ এর দিক পর্যন্ত নিজের কাজের পিছনে মোটিভেশন, witty সব বাস্তবিক উদাহরণ, কলিগদের সাথে তার বিভিন্ন সময়ের interaction উঠে আসে। এর মধ্যেই আমরা দেখতে পাই কিভাবে ধীরে ধীরে আলাদা ফিল্ড হিসেবে Behavorial Economics দাঁড়া হয়ে ওঠে, যাকে বাংলায় আচরণগত অর্থনীতি বলতে দেখেছি এখানে সেখানে। বিহেভরিয়াল ইকোনমিক্সের ডেভেলপমেন্টে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার কারণে রিচার্ড থেলার ২০১৭ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। এই বই বেরিয়েছে অবশ্য তারও বছর কয়েক আগে। বইটা পড়ার সময় বেশ কিছু আইডিয়া বেশ পছন্দ হয়, যার কারণে ঠিক করি নিজের মত করে নোট নিয়ে রাখব। সেই নোটগুলোরই প্রথমটা হচ্ছে এই পোস্ট।)

একটা আদর্শ অর্থনৈতিক দুনিয়ায় সব মানুষের একটা কমন বৈশিষ্ট্য থাকার কথা: rationality বা যৌক্তিকতা। অর্থনৈতিক তো বটেই, সব ডিসিশনই মানুষের নেওয়ার কথা যৌক্তিক ভাবে। যৌক্তিকতা মানে কি? নিজের কাজের কারণে মানুষের যেন সর্বোচ্চ লাভ বা সর্বনিম্ন ক্ষতি হয় সেইটা নিশ্চিত করা। এই জিনিসটার একটা গালভরা নাম আছে: utility maximization। কিন্তু কথা হল, মানুষ কিসে নিজের লাভ বা ক্ষতি মনে করে, এটাকে সবসময় টাকা-পয়সা (কিংবা অন্য কোন জিনিস যেটার লাভ-ক্ষতি পরিমাপ করা সহজ) দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় কিনা এটা একটা বড় প্রশ্ন। 

প্রফেসর থেলার নিজের জীবন থেকে একটা উদাহরণ ব্যবহার করেন। উনি যখন প্রথম যখন শিক্ষকতা শুরু করেন, তার একটা পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের গড় মার্কস ছিল ৭০-এর আশেপাশে। উনি যেখানে পড়াতেন (University of Rochester, NY, USA), সেখানে মার্কসের সাথে গ্রেডের সম্পর্ক আমাদের দেশের মত এত জোরালো না। ৮০ মানে এ, ৭৫ মানে এ-, এরকম ধরাবাধা নিয়ম নাই আর কি। যেহেতু একেক প্রফেসরের পরীক্ষার ডিফিকাল্টির উপর ডিপেন্ড করে ৫০/১০০ মানে হয় খুব জঘন্য পরীক্ষা, অথবা মোটামুটি ভালো পরীক্ষা, যেকোনটা হতে পারে। উনিও সুন্দর মত বলে দিয়েছেন যে তোমাদের এই নাম্বারের দিকে তাকানোর দরকার নাই, আমি "curving" করে তারপরে গ্রেড দিব। তার পরেও উনি বেশ শোরগোল শুনেন ক্লাস থেকে। "ভাল পড়েও মাত্র ৭০ পেলাম, এ কেমন বিচার?" জাতীয় কথাবার্তা আর কি। পরীক্ষার মান সহজ করার ব্যাপারে অনীহা থাকায়, একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তিনি। পরের পরীক্ষা ১০০ মার্কসে না নিয়ে, নিলেন ১৩৭ এ। কেন? "এতে গড় মার্কস ৭০ এর দিকে না থেকে থাকে ৯৫ এর আশেপাশে। এক দুইজন ১০০+ মার্কসও পেয়ে যায়।" (এইটা ১৩৭ দিয়ে ভাগ না করে ১৪০ টাইপের কিছু দিয়ে ভাগ করলেও হত, কিন্তু একটা ১৩৭ দিয়ে মুখে মুখে ভাগ করে ফেলা একটু কঠিন, এটাও হয়তো একটা ভাল ব্যাপার)।
যেহেতু শুধু মার্কস না দেখে এখনও লোকজনের পাওয়া মার্কসের ডিস্ট্রিবিউশন দেখে গ্রেড দেওয়া হবে, এতে আসলে শিক্ষার্থীদের অবস্থার কোন হেরফের হবে না। তার মানে ইউটিলিটি বাড়ানোর দিক দিয়ে, তাদের কিছু যায় আসার কথা না, যেহেতু ইউটিলিটি দিন শেষে গ্রেডের উপরেই নির্ভরশীল, এই মার্কসের উপর না। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল এই আপাত অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার (মোট মার্কস) পরিবর্তনের কারণে, জীবনে প্রফেসর থেলারকে তার গ্রেডিং নিয়ে আর কোন কমপ্লেইন শুনতে হয় নি। 

আরেকটা উদাহরণ দেখা যাক। এবার আর ক্লাসের ব্যাপার-স্যাপার না। ধরে নিন ফেসবুকে একটা ফুটফুটে বাচ্চার ছবি সহ একটা পোস্ট দেখলেন। ছয় বছর বয়সী ছেলেটার অপারেশনের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা লাগবে। তাকে সাহায্য করার উপায় জানানো থাকলে, বিকাশ হোক, ব্যাংক একাউন্ট হোক, আশা করা যায়, মানুষ নিজের জায়গা থেকে একটা এমাউন্ট দান করে বাচ্চাটার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে পারবে। এই একই মানুষগুলোকে যদি জানানো হয় যে ইনকাম ট্যাক্স আরেকটু বাড়ানো হলে দেশের হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা যাবে এবং বছরে অন্তত ১০০ জন শিশুর জীবন বাঁচবে, সেক্ষেত্রে হয়তো আর ওরকম আগ্রহ পাওয়া যাবে না। ট্যাক্সের টাকা কই যায়, হাসপাতালে দূর্নীতি হয় কিনা, এসব আপাতত হিসেবের বাইরে রাখি। এখানে মূলত যে পার্থক্যটা তা হল থমাস শেলিং এর মত identified life আর statistical life এর পার্থক্য। প্রথম ক্ষেত্রে, বাচ্চাটাকে আপনি দেখছেন, একটা পরিচয় জানছেন, এবং এটাই একটা বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। মানুষ খুব কম ক্ষেত্রেই identified life এর ক্ষতি হোক এটা চায়। এখন যৌক্তিক চিন্তার দিক থেকে কিন্তু এ পার্থক্যটা থাকার কথা না। যদি আমার সরাসরি পরিচিত না হয়, একটা identified life আর statistical life বাঁচানো, দুইটার ক্ষেত্রেই আমার সমান আগ্রহ থাকা উচিৎ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা থাকে না।

এই যে ফিক্সড ইউটিলিটির বাইরে চলে যাওয়ার মানুষের স্বভাব, এই জিনিসগুলোর কারণ হচ্ছে এসব আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার-স্যাপার। এগুলোকে irrational বলে অনেক ক্ষেত্রেই ইকোনমিক এনালিসিসের মধ্যে আনা হয় না। কিন্তু থেলার (এবং আরও অনেকে) আসলেই প্রমাণ করেন, যে এগুলোকে ব্যবহার করে আমরা ভালোমত মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ ব্যখ্যা করতে পারব। মানুষের এই ব্যাপারগুলোকেও গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে ইকোনমিক্সের মধ্যে আনাটাই এক দিক দিয়ে বলা যায় বিহেভরিয়াল ইকোনমিক্সের উদ্দেশ্য।

(চলবে)

No comments:

Post a Comment