Tour de কাঁটাতার – বান্দরবান পর্ব – ১
আমি ট্রেনযাত্রা জিনিসটাকে বরাবরই
“ভালু পাই”। রাতের ট্রেনে ভাল ঘুমও
হয়। এযাত্রায় ব্যতিক্রম
হয় নাই। রাতে কি কি নিয়ে যেন
কথা হচ্ছিল। তানভীরের ওসি নামকরণের
তাৎপর্য যেটা আবার তাজিন-এমডি ছাড়া বাকিরা কেউ পুরোপুরি জানি না(তার মানে এই না যে আমরা ওকে ওসি ডাকি না:D); শিফুর
ইতিহাসজ্ঞানের পরিধি; এমডির ক্যাপের অংশবিশেষের গোলাপী বর্ণ। যাই হোক এর মধ্যে আমি ঘুমিয়ে গেছি
আর ঘুম থেকে উঠেছি চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে। এই স্টেশনে শেষ এসেছি যখন তখনও ঘুরতে। আব্বু-আম্মু-ভাইয়ার’র সাথে সেবার কক্স’সবাজার, রাঙ্গামাটি এক দফা ঘুরে গেছি। মাথার মধ্যে সিমিলারিটি খোঁজার
অ্যাপ চালু হয়ে গেল, আমিও নোটিস করা শুরু করলাম, আরে
এইরকম হ্যান দেখসি; ঐরকম ত্যান দেখসি; ঐদিক দিয়ে মনে হয় বের হইতে হয়। সাথে দেড় লোকাল পোলা থাকায়(হামু লোকাল
আর কক্স’সবাজারের কাছাকাছি আমাদের অবস্থানের সুবাদে শিফু আধা-লোকাল) ভুলভাল কথাবার্তা বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের
পর্যবেক্ষণ নিজের কাছেই রাখলাম আর কি।
তো বান্দরবান পৌঁছতে হবে যত দ্রুত
সম্ভব, তাই সাথে সাথে রাচি-শিফু দৌঁড় দিল টিকেট কাটতে। পেয়েও গেল ৯টার টিকেট, বিআরটিসির
বাস, কাউন্টার স্টেশন থেকে অল্পই দূরে। আমরাও ট্যুরের “প্রথম যাত্রাপথে
খাওয়া” স্টেশনের বাইরেই একটা রেস্টুরেন্টে সেরে দিলাম হাঁটা। বাসটাকে দেখেই কেন জানি ভাল্লেগে
গেছিল, মাথায় যে শব্দটা প্রথম আসল, তা হল
“cool”। বাস ছাড়ল সময়মতই। এই বাস জার্নিটা পার্সোনালি আমার
জন্য ঝামেলার ছিল আমার পুরানো শত্রু “motion sickness” এর আবির্ভাবের কারণে। তার জন্য এমনিতে উল্লেখযোগ্য কিছু
ঘটে নাই ঐদিন বিকালের আগ পর্যন্ত, যাই হোক। আরেকটা যে কারণে এই জার্নিটা উল্লেখযোগ্য এই জার্নিটার
সময়েই মনে হয় প্রথম আমাদের কথাবার্তায় প্রমিনেন্ট হয়ে উঠে “কাঁটাতার”। এটার
ব্যাকগ্রাউন্ড আসলে খুবই সিম্পল। কারা কারা “বাইশে শ্রাবণ” সিনেমাটা দেখেছে জানি
না, অন্তত গান শুনে থাকার কথা। “গভীরে যাও”, “একবার বল”, “এই শ্রাবণ” ইত্যাদি। না
শুনে থাকলে কেউ শুনে দেখার পরামর্শ দেওয়া হল। তো “এই শ্রাবণ” গানটার প্রথম লাইন হচ্ছে
“আমি কাঁটাতারেই সুখী…”। আমাদের
মধ্যে সবচেয়ে ভালো গানের গলা নিরুর(সবচেয়ে
ভালো আর কি, গানের গলা আছেই এক নিরুর) আর সে কিছুক্ষন পর পরই এই গানটা গেয়ে উঠছিল।
পুরো গান জানে না বিধায় কিছুক্ষন পর পর ফিরে আসছিল কাঁটাতরের গল্পে। কাহাঁতক আর এক
গান এমনি এমনি শুনে যাওয়া যায়। কিছুক্ষন পর একে একে অনেকের মাথাতেই হয়ত এই
চিন্তাটাই এসেছিল যে কি এমন করে নির্ঝর কাঁটাতার দিয়ে যে সুখী হয়ে উঠে এক
কাঁটাতারেই। শিবলু তো গানও ধরে, “নিরু কাঁটাতারে সুখী…”(গানের
বাকি অংশ সর্বসাধারণের শোনার মত না)। সেই শুরু, তারপর থেকে কতবার যে কাঁটাতারের
অবতারণা হয় কথোপকথনে কেউই আর হিসেব করে উঠতে পারি নাই।
বান্দরবান পৌঁছলাম সাড়ে
এগারোটার দিকে। বান্দরবানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল নির্ঝর। ওর বাবার এক
কলিগের থ্রুতে লোকাল হর্টিকালচার সেন্টারের কিছু একটায়। তো আমরা ডিসিশন নিলাম যে
সেখানে না, দেরি না করে ইমিডিয়েটলি নীলগিরি ঘুরে আসা হবে। চাঁদের গাড়িতে করে যাওয়া
যায়(এই বস্তুর কথা একটু পরে এলাবোরেট করি), যেতে সময় লাগে ভালোই, গিয়ে আবার ফিরেও
তো আসতে হবে। পথে একটা শৈলপ্রপাত আর চিম্বুক পাহাড় পড়ে, যাওয়া আসা মিলে খরচ পড়বে
৪০০০ টাকা। উঠে গেলাম ১২ জন। এবার চাঁদের গাড়ির গঠন সম্বন্ধে একটু বলা যায়।
জিনিসটা আমার মূলত একটা পিক-আপের মতই লাগল, পিছের স্পেস বেশি সামনে শুধু ড্রাইভার
আর একটা প্যাসেঞ্জার সিট রেখে। আমার কেন জানি ঢাকার লেগুনা বা রাজশাহীতে আমরা
যেগুলোকে ইমা বলতাম তার কথা মনে পড়ল। বসা যায় ১০ জন, আমরা কেউ সামনে প্যাসেঞ্জার
সিটে যেতে না চাওয়ায় ১২ জন চাপাচাপি করে থেকে গেলাম, বেশিরভাগ সময়েই কেউ না কেউ
দাঁড়িয়ে থাকল আর কি। তো নীলগিরি কেউ যেতে চাইলে আর তাদের টাইমলাইন যদি আমাদের মত
হয় তবে বলে রাখ দুপুর বেলার খিদা মিটানোর মত খাবার কিনে নিয়ে যাবেন। এইখানেই ভুলটা
আমরা করেছিলাম, অল্পস্বল্প একচুয়ালি খিদা মিটানোর খাবার নিয়েছিলাম, আর সাথে
নিয়েছিলাম ডালমুট মার্কা হুদা স্ন্যাক্স(যা শেষমেশ কাজে এসেছে কিনা আমরা নীলগিরি
করে ফিরে আসার পর)। আরেকটা জিনিস নিবেন অবশ্যই, পানি, অনেক। অবশেষে যাত্রা হল শুরু, কড়া রোদ, টুপি পড়ে আছি
সবাই, কারও তাতেও কুলোচ্ছে না গামছা জড়াচ্ছে। এর মধ্যে দুজনের ক্যাপ গেল উড়ে,
সাফাত তারটা ফেরৎ পেলেও এইচের টুপি হারিয়েই ট্যুরে আমাদের “হারানো”র খাতা খুলল।
শৈলপ্রপাত যে জায়গায় সে জায়গাটা পার করে গেলাম সবার প্রথমে, ফেরার সময় দেখব এই
নিয়্যতে। যাই হোক, আঁকাবাঁকা পথ, ধীরে ধীরে উঠছি আর ড্রাইভারের স্কিলের প্রশংসা
করছি(এই কাজটা করেছিলাম বান্দরবান আসার বাস ট্যুরেও, আসলেই কতটা স্কিল লাগে এইরকম
রাস্তাগুলোতে গাড়ি চালানোও মোটামোটি বিনাক্লেশের কাজ বানিয়ে দিতে আমার চিন্তার
বাইরে) আমি আর শিফু তো প্ল্যানও করে ফেললাম এই রাস্তাতেই হবে আমাদের মুভি, “ফাস্ট
এন্ড ফিউরিয়াস – বান্দরবান ড্রিফট”। রাস্তা এমনও ছিল যে একটু দূরের কোন রাস্তা,
যেটা দেখে এই মনে হয় যে আরে ওটা কোন চিপা রাস্তা হবে, একটু পর সেই রাস্তাতেই চড়ে
বসি। আর আসলেই মজা লাগছিল উপরে উঠতে উঠতে ফেলে আসা রাস্তাগুলোকে দেখতে। বিশ্বাসই
যখন হতে চাচ্ছিল না যে ঐ রাস্তাগুলোই আমরা পার করে আসছি, তখনই ঐ রাস্তা দিয়ে
আমাদেরই মত চাঁদের গাড়ি নিয়ে কাউকে উঠে আসতে দেখি। আর এরই মাঝে দু পাশের ভিউ চেঞ্জ
হচ্ছে। আসলেই যে দুই পাশে তাকাতে কত সুন্দর লাগছিল বলে বুঝানো যাবে না। একটু পর পর
খোলা আকাশ দেখি, নিচে তাকিয়ে বুঝি আমরা কত উপরে, আর একবার করে সবাই মিলে চিৎকার
করে উঠি। যাই হোক, একটু পর হঠাৎ যখন নিচের দিকের ভিউ খেয়াল করলাম আর বহুদূরে
দেখলাম একটা এক চিলতে নদী, গাড়ি থামিয়ে না নেমে পারলাম না। ওখানেই একটা চেকপোস্টে
বসে ছিল এক পুলিশ, তাকেই জিজ্ঞেস করল কে যেন, কোন নদী। উত্তরে সে গান শুনিয়ে দিল
একটা, জানাল নদীর নাম শঙ্খ, শঙ্খ আর সাঙ্গু যে একই জিনিস তা আমি পরে জানতে পারসি
উইকি থেকে। নদীর নাম যাই হোক, দৃশ্যটা ছিল বেশিই অসাধারণ।
এর পরের স্টপ, চিম্বুক পাহাড়।
পাহাড় বলতে অনেক অল্টিচিউডের বিশাল কিছু তা না। রাস্তার ডানে আরকি বেশ খানিকটা
উঁচুতে চড়তে হয়। খাড়াই যথেষ্টই ভাল। পরে রাতে শিফু মনে হয় বলেছিল যে বান্দরবান
ট্যুরে এর চেয়েও বেশি খাড়াইয়ে যদি অনেক উঁচুতে চড়তে হয় তো খবরই আছে আমাদের। তো
আমরাও সবাই রাস্তার ধারেই একটা দোকানে চা খেয়ে উঠা ধরলাম। পাহাড়ের গায়ে ট্র্যাক
তৈরি হয়েই ছিল অনেকজন উঠতে উঠতেই। তো তা অনুসরণে এক এক করে উঠে পড়লামও সবাই।
বান্দরবানে গিয়ে আমাদের প্রথম পায়ে করে উচ্চতা অতিক্রম আর কি। চিম্বুক পাহাড়ের উপর
থেকে ভিউটাও বেশ সুন্দর। তবে যেহেতু আমরা গাড়িতে করেই যথেষ্ট উঁচুতে পৌছেছিলাম আর
কি পায়ে বেয়ে উঠা এইটুকুতে উচ্চতা আর ভিউ খুব পরিবর্তন হয়েছে দাবি করব না। তাই
ওখানে ভিউয়ের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ছবি তুলতে-তোলাতে দেখলাম আমাদের অনেকে ব্যস্ত
হয়ে পড়ল। ওখানে থাকে একটা “চড়ার যোগ্য” গাছ ছবি তোলার ব্যাপারটাকে আরও
উৎসাহব্যঞ্জক করে তুলেছিল আর কি। তো যাই হোক, চিম্বুক পাহাড় ঘোরা শেষ, নীলগিরি
পৌঁছতে হবে এই চিন্তা নিয়ে নামা শুরু করলাম। উঠেছিলাম যে খাড়াই বেয়ে সেটা বেয়েই
নামা যেত, কিন্তু আবিষ্কার করলাম যে পিছনের দিকে একটা হেলানো, ঘুরানো রাস্তা আছে
নামার জন্য। তো খামোকাই পেইন না নিয়ে নামলাম সেদিক দিয়ে। আমি, তাজিন, শাকির সবার
আগে। নেমে গাড়ির কাছে এগুতে এগুতে দেখলাম রাস্তা দিয়ে না নেমে অনেকে পাহাড় বেয়ে
নামছে। সবার সামনে শিফু। দেখে কেন যেন মনে হল ওর স্পিড ঠিক স্বাভাবিক না। একটু
বেশিই যেন। মনে হওয়াটাকেই ঠিক প্রমাণিত করে ওর গতি যেন বাড়তেই থাকল। যেন দৌঁড়ে
দৌঁড়ে নামছে সে। পড়বে-পড়বে না-পড়বে-পড়বে না ভাবছি আমি, দৌড়ের উপরেই প্রায় নিচে
এসেও গেল সে, এই সময় আমার পাশে শাকির বলল “পড়ল বলে” আর ঠিক সেই সময়েই দৌড়টা রূপ নিল
ডিগবাজিতে। রাস্তায় পৌঁছনোর ঠিক দুই-তিন ধাপ আগে ডিগবাজি খেল শিফু আর উলটে গিয়ে
পড়ল রাস্তার উপর।
সৌভাগ্যক্রমে উলটে গিয়ে হাতের
কাছে ছড়ে যাওয়া ছাড়া কিছু হয় নাই। অন্তত কিছু ভাঙে নাই বা মাথার উপর গিয়ে সে পড়ে
নাই আর কি(শুধু মনে হচ্ছিল যে, তাও তো ভাল শিফু অতক্ষন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছে,
ডিগবাজি যদি রাস্তা থেকে দুই ফুট উপর থেকে ডিগবাজি না খেয়ে বিশ ফুট উপর থেকে খেত
তবে কি হত)। ঐ ছড়ে যাওয়া চামড়াটুকুর কল্যানেই অবশ্য বাকি ট্যুরে শিফুর উচ্চারিত
সবচেয়ে কমন শব্দ হয়ে গেছিল “আঁউ”। আমাদের আনা ওষুধ-পত্রের কিছু কাজে লাগল শেষমেশ। আর
আমাদের বারোজনের মধ্যে প্রথম উইকেট পতন দেখে আমরা আবারও এগিয়ে চললাম নীলগিরির
দিকে।
No comments:
Post a Comment